Thursday, May 2, 2024

রুমি: যুক্তিতে যেখানে মুক্তি মেলে না

থ্রিলার বানানোর পূর্বশর্ত কী? অবশ্যই সেখানে এমন কিছু থাকতে হবে, যেন দর্শকের মনে রোমাঞ্চ জাগে। এই রোমাঞ্চ নানাভাবে জাগানো যায়। সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো, গল্পটাই এমনভাবে বোনা, যাতে রহস্যের ভাঁজে ভাঁজে রোমাঞ্চ গুঁজে থাকে। অর্থাৎ, একজন দর্শক বা পাঠক গল্পটি চিত্রায়িত হলে দেখতে দেখতে, বই হলে পড়তে পড়তেই সেই রোমাঞ্চময় মোড়ে এসে উপস্থিত হবেন। অনেকটা গল্পের স্রোতে ভেসে রোমাঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে কোনো ত্রিমোহনায় চোখাচোখি হওয়ার মতো বিষয়।

এর বদলে অবশ্য আয়োজন করেও রোমাঞ্চের মুখোমুখি করানো যায় দর্শকদের। তার জন্য চাই সহিংসতা বা ভয়ঙ্কর আবহ সংগীত, অতি আবশ্যিক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ, কিংবা এমন কিছু, যা দেখলেই বা শুনলেই একজন মানুষের গা’টা একটু শিউরে উঠবে। ওই ধরনের আয়োজন করে রোমাঞ্চিত করা যায় বটে, তবে তা মানসপটে ঠিক দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী থাকে না। কারণ, মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই চাপানো জিনিস খুব একটা সহজভাবে নেয় না।

ওপরের এই বড় আলোচনাটি করা মূলত ‘রুমি’ নামের একটি ওয়েবসিরিজ সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা থেকে। ঈদের আগ দিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই মুক্তি দিয়েছে এই থ্রিলার সিরিজ। সিরিজের গল্প এগিয়েছে একজন গোয়েন্দাকে নিয়ে। কাহিনি সম্পর্কে হইচই বলছে, ‘রুমি, বছর চল্লিশের একজন গোয়েন্দা-পুলিশ, যখন এক ভয়ানক দুর্ঘটনায় নিজের দৃষ্টিশক্তি হারায়, তার রাতগুলো জুড়ে থাকে অদ্ভুত সব দুঃস্বপ্ন, যেখানে তার সাথে প্রতিনিয়ত দেখা হতে থাকে অচেনা মানুষজনের। রুমির এক দুঃস্বপ্ন যখন বাস্তবে পরিণত হয়, তখন সে পেতে থাকে বিভিন্ন সূত্র, যা তাকে জানান দেয় এক অজানা ভবিষ্যতের।’

রুমি’র প্রথম সিজনের প্রথম পর্বটি খানিকটা লম্বাই। এটি প্রয়োজনও ছিল। নইলে মূল গল্পে ঢোকাটাও কঠিন। ব্লাইন্ড ডিটেকটিভের গল্প বলার জন্য আগে তো ডিটেকটিভকে ব্লাইন্ড হতে হবে! কিছু সফলতা ও ট্রমার বর্ণনার পর সেটি হলো। এবং এরপর থেকেই শুরু আসল গল্প। রুমি দেখতে থাকে দুঃস্বপ্ন, এবং সেগুলোর সঙ্গে বাস্তবের সংযোগ সাধন শুরু হয়। মনে রাখতে হবে গল্পের দুই অংশের মাঝে নির্মিতব্য এই সেতুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গল্পের প্রধান থিমই এটি। অথচ, সেই কাজটি এতটাই খেলোভাবে করা হলো!

ধরুন, আপনি এক স্বপ্নে অচেনা কাউকে দেখলেন। এরপর আপনি পরিচিতজনকে সেই স্বপ্নে দেখা মানুষের অবয়বের বর্ণনা দিলেন। এখন ওই পরিচিতজন আপনাকে কিছু ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেই পারে—‘দেখতে এমন নাকি?’ আপনি চোখে দেখলেই কিন্তু সেই ছবি দেখে বলতে পারবেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এমনই তো!’ তখন দুই পক্ষই হতে পারবে বিস্ময়াভূত। কিন্তু স্বপ্ন দেখা আপনি যদি চোখেই না দেখেন, তবে যতই চোখ-কান-নাকের বর্ণনা দিন না কেন, দুই পক্ষ পুরোপুরি নিশ্চিত হবে কীভাবে? নাকি আপনি স্বপ্নে কারও গালে তিল দেখলেন, আর আপনার বিপরীতজনও ঠিক গালে তিল থাকা একজনকে দেখেই ধরে নেবে যে, তিনিই আপনার স্বপ্নে এসে হাজির হয়েছিলেন? যদি তাই ধরে নেওয়া হয়, তাহলে বলতেই হবে যে, সেখানে যুক্তির ধ্বজা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে! তা যতই সত্য ও প্রমাণাদিনির্ভর ডিটেকটিভ গপ্পো হোক না কেন।

‘রুমি’-তে ঠিক এমন কাজটিই হয়েছে। এখানে স্রেফ শুরুর দিকের একটি উদাহরণ দেওয়া হলো মাত্র। খেয়াল করে দেখলে পুরো সিরিজের ৬টি পর্বে এমন উদাহরণ আরও পাওয়া যাবে। ফলে মাঝে মাঝেই ঠোক্কর খেতে হয় দারুণভাবে।

তবে হ্যাঁ, রুমিরূপী চঞ্চল চৌধুরী চেষ্টা করে গেছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এই শিল্পীর অভিনয় ছিল দেখার মতো। অন্ধ রুমিকে পর্দায় দেখে ত্রুটি বের করা কিছুটা কঠিনই। শুধু চঞ্চলের অভিনয় দেখার জন্যই ছয়টি পর্ব দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে।

এর বাইরে সিরিজটিতে আরও অভিনয় করেছেন শম্পা রেজা, রিকিতা নন্দিনী শিমু, আব্দুন নূর সজল, আফিয়া তাবাসসুম বর্ণ, শাহাদাত হোসেন, দীপা খন্দকার প্রমুখ। শিমু ভালো করেছেন, স্বাভাবিক ছিলেন। আর এই জায়গাটিতেই ঘাটতি ছিল আব্দুন নূর সজলের। সিরিজজুড়ে তাঁর অতি অভিনয় এবং সকল স্থান-কাল-পাত্রের প্রতি রিঅ্যাকশন হিসেবে একই এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রাখা বড্ড চোখে লাগে। সেই চোখে লাগাটা এতটাই যে, এর প্রতিক্রিয়ায় বিরক্তি উৎপাদন হওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। দীপা খন্দকারের অভিনয় দক্ষতাকে আরও ভালোভাবে ব্যবহারের সুযোগ ছিল, তবে তাঁর চরিত্রকে ততটা জায়গাই ছাড়া হয়নি। ছাড়লে বোধহয় মন্দ হতো না। একই কথা শম্পা রেজার ক্ষেত্রেও খাটে।

‘রুমি’ পরিচালনা করেছেন ভিকি জাহেদ। ভিন্ন ধারার গল্প নিয়ে কাজ করার খ্যাতি আছে এই নির্মাতার। তবে শুধু গল্পে ভিন্ন বিষয় নিয়ে এলেই তো হয় না, গল্পটা বুনতেও হয় ভালো ও শক্তপোক্ত সুতো দিয়ে। সেলাই করার সময় সুতোতে অনাকাঙ্ক্ষিত জট লাগতেই পারে। কিন্তু তা ছোটাতেই পাওয়া যায় মুন্সিয়ানার পরিচয়। জট লাগা সেলাইয়ে কাজ চলে বটে, তবে দেখতে খুব একটা সুন্দর হয় না। তাই গল্পের বিভিন্ন অংশের মধ্যে জোড়া লাগানোর কাজটা সুচারুভাবে না হলে, পুরো কষ্টটাই মাঠে মারা যায়।

ছয়টি পর্বের সমন্বয়ে ‘রুমি’ সিরিজটি এককথায় দীর্ঘ। অন্তত এভাবে গল্প শোনানোতে ৪ বা ৫ পর্বেই কাজ সারা যেত। শেষ পর্বে এসে নির্মাতা একটি চমক দিয়েছেন বটে। তা দিয়েই পড়া গেছে সিজন টু-এর ঘোষণাপত্র। তবে যেভাবে হুট করেই চমকটি হাজির হয়েছে, তাতে পরবর্তী সিজনের গল্পের লজিক্যাল কনক্লুশন নিয়ে সংশয় হয় আরও তীব্র। তবে দক্ষতার সঙ্গে সামাল দেওয়া গেলে, ভালো ফল মিললেও মিলতে পারে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষাই ভরসা।

রেটিং: ৩.৪/৫
পরিচালক: ভিকি জাহেদ
গল্প ও চিত্রনাট্য: ভিকি জাহেদ
অভিনয়শিল্পী: চঞ্চল চৌধুরী, শম্পা রেজা, রিকিতা নন্দিনী শিমু, আব্দুন নূর সজল, আফিয়া তাবাসসুম বর্ণ, শাহাদাত হোসেন, দীপা খন্দকার প্রমুখ
ভাষা: বাংলা
ধরন: ক্রাইম থ্রিলার
মুক্তি: ১০ এপ্রিল ২০২৪/ হইচই
লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক ও সাংবাদিক

এই সম্পর্কিত আরও খবর

সর্বশেষ আপডেট