Thursday, May 16, 2024

হালদায় দেখা মিললো ‘রূপালি সোনা’ খ্যাত মাছের ডিম

দেশের মিঠা পানির কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ হালদা নদীতে অবশেষে দেখা মিলেছে রূপালি সোনা খ্যাত মাছের ডিম। রোববার (১৮ জুন) মধ্যরাত থেকে পুরোদমে ডিম ছাড়েন কার্প জাতীয় মা মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস)।

জানা যায়, প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে মা মাছ অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা ‘জো’ বলে। এই জো’র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হতে হবে পাশাপাশি প্রচণ্ড বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে। এই বৃষ্টিপাত শুধু স্থানীয়ভাবে হলে হবে না, তা নদীর উজানেও হতে হবে। ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। এতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। জো’র সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হল নদীর জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা করা। পূর্ণ জোয়ার শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে দেয়।

এ বছর পাঁচটি জো অতিক্রম হলেও তীব্র দাবদাহে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, বৃষ্টি না থাকা, হালদার পানির লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, পানি প্রবাহ কমে যাওয়াসহ নানা কারণে মৌসুম জুড়েই ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় ডিম সংগ্রহকারীরা নমুনা ডিম ছাড়া পুরোদমে ডিম সংগ্রহ করতে পারেনি। এতে করে ডিম সংগ্রহকারীদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছিল। চলতি মৌসুমের সর্বশেষ জো অমাবস্যা তিথিতে রোববার সকাল ১০টার দিকে নমুনা ডিম ছাড়া শুরু করে মা মাছ এরপর থেকেই ডিম সংগ্রহকারীরা পুরোদমে ডিম পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে ছিল।

আজিমের ঘাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী আলাউদ্দিন বলেন, আমি মূলত অটোরিকশা চালক। প্রতিবছরের মতো এবারও ডিম সংগ্রহের আশায় ঋণ করে ১০ হাজার টাকায় নৌকা আর জাল ভাড়া নিয়ে ডিম সংগ্রহের আশায় হালদা নদীতে নামি। আজ (রোববার) যদি মা মাছ ডিম না ছাড়তো চরম অর্থকষ্টে দিনযাপন করতে হতো। অবশেষে সেই প্রতীক্ষার অবসান হলো।

রামদাশমুন্সির হাট পয়েন্টে ডিম সংগ্রহকারী নুরুল আলম মেম্বার বলেন, রোববার রাত ১১টা থেকে সোমবার ভোর ৫টা পর্যন্ত চারটি নৌকায় ১৬ বালতি ডিম সংগ্রহ করেছি।

গহিরার মোবারকখীল এলাকার মো. মোস্তাক বলেন, ১৮ জুন নমুনা ডিম দেখা দিলে ২ টি নৌকা নিয়ে হালদায় অবস্থান করি। মধ্যরাতে সেই কাঙ্খিত ডিমের দেখা মিলে। সোমবার ভোর ৪টা পর্যন্ত ১০ লিটারের বালতিতে ১০ বালতি ডিম সংগ্রহ করি।

আইডিএফ এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আনোয়ার বলেন, রোববার রাত ১২টার দিকে খবর পায় নাপিতের ঘোনা, আমতুয়ায় প্রচুর ডিম পাওয়া যাচ্ছে। সোমবার ভোর ৪টা পর্যন্ত হালদার বিভিন্ন পয়েন্ট হতে তিন শতাধিক নৌকায় ৭০০ ডিম সংগ্রহকারী পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম আহরণ করেন। ডিমগুলো রেনু তৈরির জন্য ৫টি হ্যাচারি রয়েছে। ৫টি হ্যাচারির মধ্যে ৪টি সরকারি ১ টি বেসরকারি।

হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ১৮ জুন মধ্যরাতে জোয়ারের সময় আমতুয়া পয়েন্টে কার্পজাতীয় মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়ে এরপর এই ডিম জোয়ার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আজিমের ঘাট, অংকুরিঘোনা, কাগতিয়ার মুখ, গড়দুয়ারা নয়াহাট, রামদাশ মুন্সির ঘাট, মাছুয়াঘোনা, সত্তার ঘাট, নাপিতের ঘোনা, কাটাখালী, আমতুয়াসহসহ হালদার বিভিন্ন পয়েন্টে এই ডিম ছড়িয়ে পড়ে। এ বছর হালদা নদী থেকে প্রচুর পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে ডিম সংগ্রহকারীসহ হালদা সংশ্লিষ্ট সবার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, এবার ১৫ জুন থেকে অমাবস্যার তিথি শুরু হয়েছে। ২১ জুন পর্যন্ত তিথির মেয়াদ আছে। ডিম না ছাড়লে ২১ জুনের পর জেলেরা নদী থেকে উঠে আসতেন। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম দেখা গেল। ভারী ও টানা বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল না থাকার পরও ‘মা মাছ’ ডিম ছেড়ে দিল। এরকম একটি দিনের অপেক্ষায় ছিলাম দীর্ঘ ২৩ বছর। এ সফলতা হালদা নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকলের।

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি এবং ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। ২০২০ সালে হালদা নদীতে রেকর্ড ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রায় সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

সূত্র: ইত্তেফাক

এই সম্পর্কিত আরও খবর

সর্বশেষ আপডেট