দেশে বর্তমানে সৌদি আরবের খেজুরের বেশ বড় একটি বাজার রয়েছে। সম্প্রসারণশীল বাজারে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। আর এ চাহিদার শতভাগই পূরণ করতে হচ্ছে আমদানির মধ্য দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়াতেও উন্নত জাতের খেজুর চাষ করা সম্ভব। আর সেটি বর্তমান বাস্তবতায় প্রমাণ করেছেন এ দেশের কয়েকজন সফল চাষি। তাদের মধ্যে অন্যতম চাষী নজরুল ইসলাম বাদল (৩০)।
গাজীপুরের সদর উপজেলার পিরুজালী ইউনিয়নের আলিমপাড়া এলাকার বীরমুক্তি যোদ্ধা জিল্লুর রহমান খানের ছেলে। শিক্ষা জীবনে গণিত বিষয় নিয়ে কাটালেও পেশা হিসেবে কৃষি বেছে নিয়ে তিনি এখন কোটিপতি। অনুকরণীয়, অনুসরণীয় এই চাষীর কাছ থেকে নিজ জেলা ছাড়াও আশেপাশের জেলার যুবকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন খেজুর চাষে, নিচ্ছেন বিভিন্ন প্রজাতির খেজুর চারা।
সরেজমিনে কৃষক বাদলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৩ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে পাস করেছেন তিনি। সেখান থেকে পাস করার পর বেকারত্ব ঘুচাতে এনজিওসহ কয়েকটি টেলি কমিউনিকেশন সংস্থায় পরিবেশকের চাকুরি করেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু পরে তিনি সব বাদ দিয়ে বাবার সঙ্গে কৃষি কাজে যোগ দেন। কৃষিকাজে নতুন সম্ভাবনার দিক খুঁজতে থাকেন বাদল। বর্তমানে তার কৃষি জীবনে ভরে উঠেছে সাফল্য গাঁথায়। শিক্ষা জীবনে গণিতের চর্চা করে ব্যক্তি জীবনে তা প্রয়োগে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন বাদল।

দেশ বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজদের জমিতে ‘সৌদি ডেট পাম ট্রিস ইন বাংলাদেশ’ নামে ব্যক্তি উদ্যোগে খেজুরের বাগান গড়ে তুলেন। খেজুর গাছ চাষের পাশাপাশি খেজুর চারার নার্সারিও গড়ে তোলেছেন ওই চাষী। গাজীপুরে মরুভূমির ফল খেজুর চাষ করে দেশে খেজুরের চাহিদা মেটানোর স্বপ্ন দেখছেন নজরুল ইসলাম বাদল (৩০)। খেজুর আবাদের সফলতায় দেশের বিভিন্ন জেলার আগ্রহী চাষীরাও তার কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে খেজুর চাষে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন। সৌদি আরবের খেজুর চারার নার্সারিটি নজরুল গড়েছেন শুধু চারা বিক্রির জন্যই নয়, মানুষ যেন খেজুর বাগান করার নিয়ম সম্পর্কে জানতে পারে সে বিষয় মাথায় রেখে এ কাজটি করেছেন।
জানা গেছে, খেজুর, আরবিতে যাকে বলা হয় তুমুর। সৌদি আরবে রয়েছে নানা জাতের খেজুর। আজওয়া, আনবারা, সাগি, সাফাওয়ি, মুসকানি, খালাস, ওয়াসালি, বেরহি, শালাবি, ডেইরি, মাবরুম, ওয়ান্নাহ, সেফরি, সুক্কারি, খুদরিসহ এসব খেজুরের রয়েছে বাহারী নাম। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ হাজার জাতের খেজুর রয়েছে। আমাদের দেশেও এর রয়েছে প্রচুর চাহিদা। বিশেষ করে রমজান মাসে খেজুরের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে। আর এ চাহিদার শতভাগই পূরণ করতে হচ্ছে আমদানীর মাধ্যমে। তবে বাদলের স্বপ্ন দেশের উৎপাদিত খেজুরে শতভাগ চাহিদা পূরণের।
কৃষক নজরুল ইসলাম বাদল জানান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে সম্মান ডিগ্রী অর্জনের পর কৃষক পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমানের সাথে কৃষিকাজে মনোযোগ দেন। তখন থেকেই কৃষিতে নতুন কিছু করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। সেই ভাবনা তাকে নিয়ে যায় সৌদি আরব প্রবাসী এক বন্ধুর কাছে। ২০১৫ সালে শুরুর দিকে ওই বন্ধুর সহযোগিতায় খেজুরের চাষ ও নার্সারী করার পরিকল্পনা করেন। মরুভূমি অঞ্চলের ফসল বাংলাদেশের কাদামাটির ফলানো সম্ভব কিনা তা নিয়েও তার ভাবনার অন্ত ছিল না। তারপরও প্রবাসী ওই বন্ধুর সহযোগিতায় বিশ্বের ৬টি দেশ থেকে বিভিন্ন জাতের খেজুরের বীজ ও চারা সংগ্রহ করেন বাদল। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর প্রথমে ১৮টি চারা রোপন করে মরুর খেজুরের চাষ শুরু করেন।
বাগানটি শুরু করতে প্রথমেই তার খরচ হয়েছে ৫২ লাখ টাকা। প্রথমে ৭০ শতক জমিতে সৌদি আরবের খেজুরের জাত নিয়ে বাগান শুরু করেন। ২০১৭ সালে প্রথম তার বাগানের খেজুর গাছে ফলন আসতে শুরু করে। খেজুরের বীজ কিংবা সাকার থেকে চারা উৎপাদন করে খেজুরের নার্সারিও গড়ে তোলেন। সেই বছরেই বাগান থেকে ৬২ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি। বর্তমানে তার বাগানে ও নার্সারিতে ১৬ প্রজাতির খেজুর গাছ রয়েছে। তারপরও মানুষের ব্যাপক চাহিদার যোগান দিতে আরও ১৪ জাতের চারা বাইরে থেকে এনেছেন। বর্তমানে নার্সারিসহ তার খেজুর বাগানটি সাড়ে ৭ বিঘায় সম্প্রসারিত করেছেন। সাকার থেকে উৎপাদিত চারায় ফলনের হার বেশি। সাকারের চারা রোপনের এক/দুই বছরের মধ্যেই খেজুর ধরে। এ ধরনের প্রতিটি সাকারের দাম ২৫ হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আর খেজুর ধরা অবস্থায়ও চারা বিক্রি করা হয়, যার দাম হলো ৩ লাখ টাকা। বাগান পরিচর্যা ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিমাসে তার ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়।
চাষী নজরুল ইসলাম বাদল আরও জানান, পরীক্ষামূলকভাবে তিনি শুরুতে বিভিন্ন জাতের ১৮টি গাছ রোপন করেছিলেন। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর প্রথমে ১৮টি চারা রোপন করে মরুর খেজুরের চাষ শুরু করেন। এ বছরও বাগানের গাছগুলোতে অনেক খেজুর ধরেছে। এক একটি খেজুরের বাঁধার ওজন প্রায় ২৫ কেজি। তার এ সফলতা খেজুর চাষে আগ্রহীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। নতুনভাবে খেজুর চাষে অগ্রহীদের মধ্যে তার এ সফলতা প্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি ৩০ হাজার চারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে খেজুরের নার্সারি গড়ে তোলেছেন। তার সংগ্রহে খেজুরের যেসব জাত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আজওয়া, মরিয়ম, আম্বার, খুনিজি, হেলালি, ম্যাডজেলি, বারহি, খালাস, ওমানি, সুক্কারি, সাফাওয়ি ইত্যাদি। যেভাবে ফলন হচ্ছে তা ঠিক থাকলে অচিরেই তিনি দেশে খেজুরের চাহিদা মেটাতে পারবেন বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।

চারা সংগ্রহের প্রক্রিয়া: টিসু, কলম (সাকার) ও সরাসরি বীজ থেকে উৎপাদিত চারা। টিস্যু ও কলম চারা থেকে ১ থেকে ২ বছরে ফলন পাওয়া যায়। একটি টিস্যু চারা ৮ থেকে ১০ হাজার, কলম চারা ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং বীজের চারা ৮শ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।
খেজুরের ফলন: একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছে ৮/১২টি বাধি ধরে। প্রতি বাধিতে ২৫ থেকে ৩০ কেজি করে খেজুর হয়। তাছাড়া বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় ফলন আসতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ বছর। বীজ থেকে উৎপাদিত চারার দাম তুলানামূলক কম। এখানে চারা ছাড়াও খেজুরও বিক্রি করা হয়।
দেশের খেজুরের চাহিদা পূরণের টার্গেট: দেশে বছরে প্রায় ৩০ হাজার মে. টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। যার পুরোটাই আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। দেশে খেজুর বাগান করতে সরকারের কৃষি বিভাগের সহযোগীতা পেলে আগামি ১০বছরের দেশে উৎপাদিত খেজুরই দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব বলেন বাদল। এ ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ, কৃষকদের প্রযুক্তিগত সহযোগীতা ও প্রশিক্ষণ দিতে পারলে দেশে খেজুর চাষে হাজারো চাষি তৈরি হবে। কৃষকের মধ্যে খেজুর চারা সহজলভ্য ও কম মূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ হতে পারে খেজুর উৎপাদনের সম্বাবনাময় দেশ।
খেজুরের চাষ পদ্ধতি রপ্তের বিষয়ে বাদলের বাবা মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন সৌদি আরবে বেশ বড় খেজুর বাগানের দেখাশোনা করতেন। সেখানে কাজ করার সুবাদে খেজুরের চাষ সর্ম্পকে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তিনি। খেজুর গাছে জৈব সার প্রয়োগই বাগানের প্রধান যত্ন। আর জৈব সারের পাশাপশি জমিতে বছরে একবার রাসায়নিক সার হিসেবে পটাশ ও টিএসপি প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত সৌদি খেজুর গাছে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ফুল ধরে এবং জুলাই-আগস্ট মাসে ফল পেকে যায়। গাছে ফল আসার জন্য সচরাচর তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে ফসল উৎপাদনের উপযোগী খেজুর গাছে ফল আসতে সাত থেকে দশ বছর সময় লেগে যায়।
বাদলের চারা নিয়ে অন্যরাও সফল: ময়মনসিংহের ভালুকার পাঁচগাঁও এলাকার মাদ্রাসা শিক্ষক মো. বিল্লাল হোসেন জানান, ২০১৯ সালে তিনি গাজীপুরের নজরুল ইসলাম বাদলের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বারহী জাতের একটি এবং ৫০ হাজার টাকায় মরিয়ম জাতের একটি খেজুর গাছের সাকার কলমের চারা ক্রয় করি। বাদল ভাই নিজে এসে চারা দুটি তার জমিতে রোপন করে দিয়ে গেছেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে খেজুর গাছে ফুল আসে, মার্চেই তা ফলে পরিণত হয়। তাদের মধ্যে মরিয়মের জাতটি বারোমাসি হয়েছে। তিনি বাদলের কাছ থেকে আবারও ৭৫ হাজার টাকায় একটি হেলালী, একটি আম্বার ও একটি খুদরি জাতের সাকারের কলম চারা ক্রয় করেছেন।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকার হাজী মমতাজ উদ্দিন জানান, তিনিও বাদলের কাছ থেকে চারা কিনেছেন। তাতে ভাল ফলন হচ্ছে। ২০২০ সালে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি দুইটি খেজুর চারা ক্রয় করেছিলেন। ২১ মাস পরে এসব গাছে ফুল ও ফলন আসে। এখন প্রতিটি গাছে চারটি বাঁধির খেজুরগুলো পরিপক্ক হয়েছে।
গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, আমি প্রায় ৬ মাস হয় গাজীপুরে যোগদান করেছি। তারপরও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামে প্রায় তিন বিঘা জমিতে সফলভাবে সৌদির খেজুর চাষ করছেন বাদল নামের এক যুবক। বাংলাদেশে সৌদি আরবের খেজুর চাষ একটি সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য। এর জন্য কৃষি পর্যায়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
সূত্র: ঢাকা মেইল